(‘মানসিক আঘাত থেকে আরোগ্য লাভ’ বইয়ের আলোকে)
দীপংকর রেমা
ট্রমা হিলিং মাস্টার ফেসিলিটেটর, বাংলাদেশ
পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যার কোন কষ্ট বা যাতনা নেই। শিশু ভূমিস্ত হওয়ার পর পরই কান্না দিয়ে শুরু হয় তার জীবন। আর সেই কান্না তার মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে। অবশ্য দ্বিতীয়টি তার মৃত্যুর কারণে অন্যদের কান্না বা কষ্ট। অর্থাৎ আমাদের জীবন কান্না দিয়ে শুরু আবার কান্না দিয়ে শেষ। জীবনের শুরু আর শেষ এর মাঝখানে অতিবাহিত হয় বহু বছর। কখনো আনন্দ, কখনো কষ্ট- এভাবেই ছুটে চলে জীবন। কেউ কষ্ট পায় কোনকিছু পাওয়ার আশা করে না পেয়ে; কেউ কষ্ট পায় পেয়ে হারানোর মাঝে; কেউ কষ্ট পায় প্রিয়জনের কাছ থেকে; কেউ সমাজে লোকদের কাছ থেকে; কেউ অফিসের বস্ অথবা সহকর্মীদের কাছ থেকে। আবার কেউ ব্যবসায় লোকসান হওয়ার; কেউ প্রিয়জনদের মৃত্যুর কারণে; কেউ আবার কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা কোন দুর্ঘটনার কারণে।
এইসব কষ্ট থেকে মানুষ মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হন। আর এই আঘাত থেকে হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যা পুরোপুরি আরোগ্য পেতে অনেক সময় লেগে যায়। এই আঘাতে ফলে হৃদয়ের ক্ষতকেই মানসিক আঘাত বা ট্রমা (Trauma) বলা হয়। মানসিক আঘাতের সাথে শোক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শোক ছাড়া কোন মানসিক আঘাত পুরোপুরি আরোগ্য হয় না। আরোগ্যের এই সময়টা একটি শোকের যাত্রার মত।
শারীরিক আঘাত সহজেই দেখা যায়। তাই এর চিকিৎসা করা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু মানসিক আঘাত দৃশ্যমান নয় বিধায় এটি চিকিৎসা করা বেশ কঠিন। কোন কোন আঘাত এমন কারো কাছ থেকে পেয়ে থাকে যা হয়তো পৃথিবীর অন্য কাউকে বলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যিনি আঘাত দিয়েছেন আর যিনি আঘাত পেয়েছেন এই দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এই ধরণের আঘাত অনেক সময় তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। কেউ কেউ এই ধরণের আঘাত ভুলে থাকার জন্য নেশায় আসক্ত হন আবার কেউ কেউ আত্মহত্যার মত পথও বেঁচে নেন। বিশেষ করে যুবক-যবতীদের ক্ষেত্রে এর প্রবণতা বেশী দেখা যায়। শরৎ চন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেবদাস’ -এ নায়ক দেবদাস নায়িকা পার্বতীকে তার জীবনে না পেয়ে কষ্ট ভুলে থাকার জন্য নেশায় আসক্ত হয়ে জীবকে বিপন্ন করেছিলেন। যা শেষ হয়েছিল মৃত্যুর মধ্যদিয়ে। তাছাড়া এই মানসিক আঘাতজনিত ক্ষত তীব্রতর আকার ধারণ না করা পর্যন্ত সাধারণত মানুষ অন্যকে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। নিজে ভিতরে ভিতরে কষ্টে ছারখার হয়ে যান।
কোন দুর্ঘটনা বা রোগের কারণে প্রিয়জনের মৃত্যুতে মানুষ তীব্র মানসিক আঘাত পেয়ে থাকেন। যা হৃদয়ে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করে। এ ধরণের আঘাতপ্রাপ্ত হলে ১ থেকে দেড়মাস পযর্ন্ত ক্রোধ বা অস্বীকার অবস্থার মধ্যে থাকে। অর্থাৎ এ সময় হঠাৎ কাঁদতে আরম্ভ করবেন ও রেগে উঠতে পারেন। স্বজন হারানো ব্যক্তি বিশ্বাস করতে পারেন না যে এটি ঘটেছে; মাঝে মাঝে সে মৃত ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখেন ও তার কথা বলেন। তিনি নিজেকে দোষারোপ করতে থাকেন- যদি এরকম বা ঐরকম করতাম তবে এই ঘটনা হয়ত ঘটত না। অনেকে এটিকে মন্দ আত্মার কাজ বলে মনে করেন। আসলে পৃথিবীর প্রায় সকল মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের ক্ষেত্রেই এরুপ ঘটে থাকে। এটি কোন মন্দ আত্মার কাজ নয়।
২য় ধাপে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিরাশার মধ্যে অবস্থান করেন। এ সময় মানুষ নিরাশ ও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্বাভাবিক জীবন তার কাছে খুব কঠিন বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে মৃত ব্যক্তিকে ফিরে আশার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। নিজেকে দোষী ভাবেন। নিঃসঙ্গ মনে হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেকে মেরে ফেলতে চায়। এ অবস্থা ৬-১৫ মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
৩য় ধাপে অর্থাৎ ৬-১৫ মাস পরে নতুন আরম্ভের সুচনা হয়। এ সময় হারানোকে মেনে নেয়া শুরু হয়। কোন দম্পতির যদি সন্তান মারা যায় তবে তারা আবার সন্তান নেয়ার কথা চিন্তা করেন। কারো যদি স্বামী বা স্ত্রী মারা যায় তবে আবার নতুন জীবন শুরু করার কথা চিন্তা করেন। অর্থাৎ ক্ষতি পূরণ করার চিন্তা শুরু হয়। তবে আগের মত আর থাকে না পরিবর্তিত হয়ে যায়।
হৃদয়ের ক্ষত থেকে আরোগ্যের জন্য শোক করা প্রয়োজন। কোন রকম শর্টকাট পদ্ধতিতে আরোগ্য সম্পূর্ণ হয় না। অনেকেই আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভুলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতে পরবর্তীতে এটি আরো তীব্র হতে পারে। যীশু নিজেও আমাদের পাপের জন্য যাতনা ভোগ করেছিলেন। ক্রুশের উপর দণ্ডায়মান অবস্থায় বেদনার্থ আবেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “ঈশ্বর আমার, ঈশ্বর আমার তুমি কেন আমাকে পরিত্যাগ করেছ।” তিনিও লাসারের মৃত্যু সময় কেঁদেছিলেন (যোহন ১১:৩৫)। তাই হৃদয়ের ক্ষত আরোগ্যের জন্য উল্লেখিত শোকের যাত্রার ধাপগুলো পেড়োনো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের লোকদের ও তার বন্ধু-বান্ধবের সহযোগীতা প্রয়োজন। এছাড়াও আঘাত প্রাপ্ত ব্যক্তি যার সাথে তার কষ্টের কথা শেয়ার করবেন তাকেও বিশ্বস্ত হতে হবে ও গোপনীয়তা রক্ষা করা প্রয়োজন। আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সাহায্য ও সহানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে যেন তার কষ্টকে বাড়িয়ে না তোলেন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আমাদের অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন জাগ্রত হয় আর তা হল- আমরা ঈশ্বরের সন্তান এবং ঈশ্বর যদি আমাদের ভালবাসেন তাহলে কেন আমাদের জীবনে কষ্ট বা যাতনা আসে!! অনেকের ধারণা যাতনা বা কষ্ট আসে শুধুমাত্র মানুষের কৃতকর্ম বা পাপের কারণে।
যদিও আমরা কেউ বলতে পারি না যে কেন আমাদের জীবনে কষ্ট বা যাতনা আসে। তবে বাইবেল থেকে আমরা জানতে পারি যে
আমাদের জীবনে যাতনা আসে নিম্ন লিখিত কারণে:
১। আমাদের আদি পিতা-মাতার অবাধ্যতা বা পাপের কারণে
২। শয়তানের কারণে ও
৩। আমাদের (মানুষের) মন্দতাকে বেছে নেওয়ার কারণে
আবার ঈশ্বর যাতনাকে ব্যবহার করেন আমাদের বিশ্বাস পরিশোধন করার জন্য।
বাইবেল বলে- আদম ও হবার পাপের কারণে পৃথিবীতে পাপ প্রবেশ করে। আদম-হবা সমগ্র মানব জাতির পূর্ব পুরুষ ও মহিলা। তারা যখন ঈশ্বরের অবাধ্য হলেন তখন পাপ এবং মৃত্যু পৃথিবীতে প্রবেশ করল (আদিপুস্তক ৩:১-২৪)। সমগ্র মানব জাতি, খ্রীষ্ট বিশ্বাসী এবং অন্যান্য সকলেই আদম ও হবার অবাধ্যতার প্রভাব উপলব্ধি করছে (রোমীয় ৫:১২)।
শয়তান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং আমাদের দ্বারাও ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণ করার চেষ্টা করে। যারা তার (শয়তানের) বাধ্য হয় তারা মিথ্যা কথা বলে, হত্যা করে এবং ধ্বংস করে। শয়তান ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ করেছে, সে চায় মানুষ ও আত্মাকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তৈরী করতে (লূক ২২:৩১ পিতর ৫:৮-৯)।
স্বর্ণকে যখন আগুনে পোড়ানো হয় তখন তার মধ্যে থাকা সকল খাদগুলো উপরে উঠে আসে এবং তা স্বর্ণ থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। যাতনা হল ঠিক তেমনি আগুনের মত যা আমাদের অন্তর থেকে সকল কালিমা দূর করে ঈশ্বরের উপর আমাদের বিশ্বাসকে পরিশোধিত করে (১ পিতর ১:৬-৭)।
আমাদের কষ্ট বা যাতনা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের সকল কষ্টগুলোকে যীশুর ক্রশের কাছে নিয়ে আসতে পারি। আর একমাত্র ঈশ্বরই পারেন আপনার আমার কষ্টগুলোকে আরোগ্য করতে। তবে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা হল- ক্ষমা। নিজেদের জন্য যেমন ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন ঠিক তেমনি আপনি যাদের কারণে কষ্ট পেয়েছেন তাদেরকেও সম্পূর্ণ ক্ষমা করা উচিত। আর তখনই আপনার হৃদয়ের ক্ষতের আরোগ্যলাভ সম্পূর্ণ হবে।